ফেসবুক ব্যবহারে সতর্ক হোন

তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে যোগাযোগের জন্যে স্যোশাল মিডিয়ার গুরুত্ব ও প্রভাব অপরিসীম। প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের দেশে ফেসবুক একটু বেশিই জনপ্রিয় মাধ্যম। পারস্পারিক যোগাযোগ, বার্তা আদান-প্রদান, মতামত প্রদান, ছবি শেয়ারিং ইত্যাদি আরও অনেক সুযোগ সুবিধার জন্য ছোট বড় সকলে ফেসবুক ব্যবহার করে। নানা পেশা ও বয়সের মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করলেও আমাদের দেশের তরুণরাই বেশি ব্যবহার করে। যেহেতু ব্যবহারকারীদের অধিকাংশই কম বয়সী তাই ফেসবুক ব্যবহার করার আগে এর নেতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। যদি কেউ ফেসবুক ব্যবহারে অসতর্ক থাকে অথবা আসক্তিতে ভোগে তাহলে এর পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে। প্রতিটি প্রযুক্তির ন্যায় ফেসবুকেরও কিছু নেতিবাচক দিক আছে। নিচে কয়েকটি নেতিবাচক দিক তুলে ধরা হলো।



ফেসবুক ব্যবহারে সতর্ক হোন

১। একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য ফেসবুকে শেয়ার করা
অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারী আছেন যারা না বুঝেই ব্যাক্তিগত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফেসবুকে শেয়ার করে। যেটা তার নিজেও জানে না যে তারা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। এর ফলে ব্যক্তিগত ব্যাপার বলতে আর কিছুই থাকছে না। আপনার সম্পর্কে আগ্রহী যে কেউই (ভুয়া আইডি ব্যবহার করে যিনি আপনার সম্পর্কে গোয়েন্দাগিরি করতে চাচ্ছেন) আপনার সম্পর্কে ধারণা করতে পারবেন এবং হীন উদ্দেশ্যে এই তথ্য ব্যবহার করতে পারবে। আপনাকে ব্ল্যাকমেইলও করতে পারবে। এজন্য নিজের ব্যক্তিগত কিছু শেয়ার করার আগে ভেবে দেখবেন যে এটা শেয়ার করলে আপনার কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা আছে কি না।

২। ফেসবুককে শুধুমাত্র একটি বিনোদনের মাধ্যম মনে করা

অনেক ফেসবুককে শুধুমাত্র একটি বিনোদনের মাধ্যম ভেবে ভুল করে। ফেসবুকের সাথে জড়িয়ে আছে পুঁজিবাদী ব্যবসায়ীদের এক বিশাল বাণিজ্য। একটু খেয়াল করলে দেখবেন আপনার ফেসবুক পেইজে যে বিজ্ঞাপণগুলো দৃশ্যমান হচ্ছে, আপনার বন্ধুর ক্ষেত্রে একই বিজ্ঞাপন দৃশ্যমান হচ্ছে না। একেক জনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনের ধরণ আলাদা। আপনার অগোচরেই আপনার ব্যাক্তিগত তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ হয়ে আপনার উপযোগী (আগ্রহ, রুচি, অভিজ্ঞতা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে) কিছু বিজ্ঞাপন আপনার সামনে দৃশ্যমান হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য একটাই আপনি যাতে কিছু সুনির্দিষ্ট পণ্য বা সেবার প্রতি আগ্রহী হতে পারেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে শেয়ার করা কোন তথ্য সার্ভার থেকে হারিয়ে যায় না। সব তথ্য তারা খুব যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করে এবং তাদের স্বীয় স্বার্থে এসব তথ্য উপাত্ত ব্যবহার করে। তাদের বিরুদ্ধে এমনও অভিযোগ আছে- ব্যবহারকারীদের তথ্য উপাত্ত বিভিন্ন কোম্পানি, বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, গবেষণা ফার্ম, গোয়েন্দা সংস্থার কাছে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেন। অভিযোগ সত্য অথবা মিথ্যা যাই হোক, ব্যক্তিগত কোন কিছু শেয়ার করার ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।

৩। ফেসবুক আসক্তি

শিক্ষার্থীদের মধ্যে ফেসবুক আসক্তি অভিভাবকদের জন্য একটি নতুন দুশ্চিন্তার বিষয়। অনেকেই অভিযোগ করেন যে তাদের ছেলে মেয়ে পড়াশোনা বাদ দিয়ে সারাক্ষণ ফেসবুক নিয়ে মেতে থাকেন। এমনকি রাত ১২টার পরেও ফেসবুকে সময় অতিবাহিত করেন। সন্তানের এই আসক্তি যে বাবা-মায়ের জন্যে কতটা উদ্বেগজনক সেটা বলে বোঝানো যাবে না। রাতের বেলায় না ঘুমানোর ফলে ছাত্রছাত্রীদের কর্মদক্ষতা ও স্মৃতিশক্তি ক্রমশ লোপ পাচ্ছে। পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারছে না বলে পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল করছে। সন্তান একবার ফেসবুকে আসক্ত হয়ে গেলে তাকে এই আসক্তি থেকে উদ্ধার করা খুবই কষ্টকর এবং অনেক সময় সেটা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে পিতা-মাতাকেই সতর্ক হতে হবে।

৪। ফেসবুক ব্যবহারকারীরা নিজেদেরকে অন্যের তুলনায় কম সুখী মনে করা

ফেসবুক ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে- দীর্ঘদিন ফেসবুক ব্যবহারের ফলে মানুষের মধ্যে অতৃপ্তি তৈরি হতে পারে। ২০১৩ সালে একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মানুষ যত বেশি ফেসবুকে সময় কাটাচ্ছে সে তত বেশি নিজেকে অসুখী মনে করছে। তারা দেখিয়েছেন- মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ালেও ফেসবুক ব্যবহার চূড়ান্ত পরিণামে মানুষকে অসুখী করে তুলছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীরা নিজেদেরকে অন্যদের তুলনায় কম সুখী মনে করে। ফেসবুকে অধিকাংশ মানুষই তার সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলোকে ক্যামেরায় ধারণ করে ফেসবুকে শেয়ার করে। আপনার কোনো বন্ধু অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গায় ভ্রমন করতে গিয়ে সেখানে ছবি তুলে শেয়ার করলে আপনার বন্ধুর একটি সুন্দর ছবি দেখে আপনার মনের মধ্যে সেখানে না যেতে পারার এক ধরনের অতৃপ্তি তৈরি হতে পারে। অন্যের আনন্দের মুহূর্তগুলো দেখতে দেখত আপনি নিজেকে অসুখী মনে করতে পারেন।

৫। ফেসবুক ব্যবহারকারীরা ধীরে ধীরে ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে ওঠে

ফেসবুক ব্যবহারের মাধ্যমে নিজের সাফল্যে, আনন্দমুহূর্ত অথবা ভ্রমণের গল্প খুব অনায়েসেই শেয়ার করতে পারে। এর মাধ্যমে অনেক মানুষ নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করে এবং সামাজিকভাবে তার অবস্থানকে একটু উপরের দিকে তুলতে চায়। নিজেকে অন্যের কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু সমস্যা হলো, সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে তা না করে বায়বীয় প্রচারের দিকে ব্যবহারকারীদের মনোযোগ অনেক বেশি। ফলে অনেক ব্যবহারকারী মনের অজান্তেই এক ধরনের বায়বীয় অসুস্থ প্রতিযোগিতা এবং ঈর্ষাবোধে লিপ্ত হয়।

৬। অতিমাত্রায় ফেসবুক ব্যবহার মানুষকে বিচ্ছন্ন ও অসামাজিক করে তুলছে

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে মানুষ কতটা সামাজিক হচ্ছে? এই বিতর্ক আজ সারা বিশ্বব্যাপী। অতিমাত্রায় ফেসবুকে সময় কাটানোর ফলে মানুষ ক্রমাগত বিচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে, জনসমুদ্রে থেকেও মানুষের মধ্যে এক ধরনের একাকীত্ব তৈরি হচ্ছে। তার গুনগত মান নিয়ে আমরা সবাই সন্দিহান। ড্রইং রুমে পরিবারের সবাই উপস্থিত থাকলেও কেউ কারো সাথে কথা বলছে না, মনোযোগ দিচ্ছে না। সবাই ফেসবুকে ব্যস্ত। বন্ধুর তালিকায় শত শত বন্ধুর নাম কিন্তু বিপদে পড়লে খুব কম বন্ধুকে পাশে পাওয়া যায়। বাকীরা শুধু দুঃখিত কমেন্টস দিয়ে বন্ধুর প্রতি দায়িত্ব পালন করেন। কয়েকটি লাইক আর কমেন্টস করলেই বন্ধুদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব কি শেষ হয়ে যায়? বন্ধুদের সুখে-দুঃখে বিপদে আপদে তার পাশে সশরীরে উপস্থিত হয়ে কিছু করতে পারার নামই প্রকৃত বন্ধুত্ব। অন্যের প্রয়োজনে আমরা যদি মমতা ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত না করতে পারি এত বন্ধুর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করাটাও একধরনের অর্থহীন।

নেতিবাচক দিক ছাড়াও ফেসবুকের অনেক ভালো দিক আছে। একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই নির্ভর করছে- আমরা কিভাবে ফেসবুক ব্যবহার করছি তার উপর।

আমাদের দেশে বহু শিক্ষার্থী আছে যারা ফেসবুকে প্রচুর সময় নষ্ট করছে। রাত জেগে ফেসবুক ব্যবহারের কারণে বহু ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনা দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এত বহু শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, অনেক পিতা-মাতার স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। সে বিষয়টি আমরা দেখেও না দেখার ভান করছি। তাই আমাদের এসব ব্যাপারে ভালো করে ভেবে ব্যবহার করা উচিত। শুধু ফেসবুক নিয়ে পরে থাকলেই হবে না। নিজেকে রিফ্রেস রাখতে মাঝে মাঝে বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন। আর ঘুরে বেড়ানোর সকল তথ্য পাবেন আমাদের ভ্রমণকাল এই ওয়েব সাইটে।

Post a Comment

0 Comments